দশাশ্বমেধে একটা বেলা।
মাইলস্টোনের সংখ্যাগুলো ধিরে ধিরে কমছিল। দশ, নয়, আট, সাত- তার পর থমকে গেল।
প্রায় চল্লিশ মিনিট বাসে বসে থাকার পর নামলাম। সামনে-পিছনে বিশাল ট্রাফিক জ্যাম। এ
জট ছাড়তে ক’ঘন্টা লাগবে কে জানে! রাস্তার পাশে একটা দোকানে চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা
করলাম –‘ইহাঁসে মন্দির কিত্না দূর হ্যায়?’ –“কৌন সা মন্দির?” বুঝলাম আহাম্মকের মত
প্রশ্ন করেছি। এটা তারকেশ্বর নয়- বারাণসী। লোককথা অনুযায়ী বারাণসীতে মন্দিরের
সংখ্যা একলক্ষ। অন্তর্জাল বেদ উইকিপিডিয়া মতে সংখ্যাটা সাতাশ হাজার।
আমার আর দুই সঙ্গীর সাথে আলোচনা করা প্ল্যান পালটানো হল। কাশীশ্বর বিশ্বনাথ কে
দর্শন করেই যাব। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে, বারকয়েক অটো পালটে, রেললাইন টপকে, বেশ
খানিকটা হেঁটে যখন কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে বারোটা। আমাদেরও। খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে। এলাহাবাদ থেকে বেরিয়েছি
ভোর চারটেয়, পথে কয়েক পিস্ বিস্কিট ছাড়া জোটেনি কিছুই। সারা রাস্তা শুধু জ্যাম আর
জ্যাম। খাবার নয়, ট্রাফিক। সামনে একটা বাঙালী খাবারের দোকান। বিশুদ্ধ বাঙালী দুপুরের ভোজন সেরে, বেশ খানিকটা
জিরিয়ে বেরোলাম দোকান থেকে। এবার বাবা বিশ্বনাথের অ্যাপয়েণ্টমেন্ট জোগাড় করতে হবে। সবই ভোলানাথের কৃপা।
পিতৃমাতৃহীন এই দেবতাটি ভারতবর্ষের হিন্দু দেব দেবীদের মধ্যে পপুলারিটিতে
সবচেয়ে এগিয়ে; কিছুটা কম্পিটিশন করতে পারেন বিষ্ণু, তাও তার দুই অবতার রাম ও কৃষ্ণ
কে সঙ্গে নিয়ে। আর্য- অনার্য- দ্রাবিড় এই তিন সংষ্কৃতির এক অদ্ভুত সঙ্গম এই শিব। আসমুদ্র হিমাচলে
পূজিত হন লিঙ্গ প্রতিকে। লিঙ্গরূপী শিব। তাতে
স্ত্রী-পুরুষ উভয় লিঙ্গই বর্তমান; শিব অর্দ্ধনারীশ্বর। Paradox কথাটা সবচেয়ে বেশি
প্রযোয্য এই শিবের ক্ষেত্রে। যাঁর স্ত্রী স্বয়ং অন্নপূর্ণা তিনি ভিক্ষা করেন;
ত্রিকালজ্ঞ, অনর্গল বেদ বলতে পারেন অথচ শ্মশানে মশানে গাঁজা ভাং খেয়ে ঘুরে বেড়ান;
সদাই আশুতোষ কিন্তু প্রলয় নাচন নাচতে পারেন; ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসার কিন্তু শিবের
মত বোহেমিয়ান কেউ নেই। যদি নারী হতাম তবে
একটা কথা বলতাম- এই পৃথিবীতে প্রেমে পড়ার যোগ্য পুরুষ একজনই- শিব। মদনকে যিনি আবলীলায় ভষ্ম করে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর
স্ত্রী বিয়োগে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। পৃথিবী
ধ্বংস হবার উপক্রম হয়েছিল। হিন্দু পুরাণ মতে শিবের জন্য allotted duty হল ধ্বংস করা, তিনি
প্রলয়ের দেবতা। সৃষ্টির দেবতা হলেন ব্রহ্মা। এই প্রলয়ের দেবতাটি এমন একটি কান্ড
ঘটিয়েছিলেন যে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার কাজ কমে গেছে। হয়তো তাঁর পপুলারিটিও তাই এত
কম। একামাত্র রাজস্থানের পুষ্কর ছাড়া আর আর কোথাও ব্রহ্মার পুজো হয় বলে শুনিনি।
এবার গল্পটা বলি।
দেবতাদের পরামর্শমত কামদেব মদন এসেছেন শিবের ধ্যানভঙ্গ করতে, সাথে হিমালয়
কন্যা উমা। প্ল্যানটা হল, অনঙ্গর শরবিদ্ধ মহাদেব আকৃষ্ট হবেন অপরূপা পার্বতীর
প্রতি। তাঁদের মিলনে সৃষ্ট পুত্রই একমাত্র পারবে কর্ত্তিকাসুরের হাত থেকে স্বর্গ
দখলমুক্ত করতে। বসন্ত এসে গেছে। পার্বতী কনফিডেন্ট- এ বুড়ো তার রূপে মুগ্ধ না হয়ে
যাবে কোথায়। দুরু দুরু বুকে ঝোপের আড়াল থেকে ফুলের ধনুক্ থেকে তির ছুড়লেন মদন। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের আর
যে কেউ হলে এই বানে বিদ্ধ হয়ে ছট্ফট্ করতেন। তিনি কামজয়ী। ধ্যানভঙ্গ হল বটে, তবে কামের পরিবর্তে সৃষ্টি হল ক্রোধ।
“তপঃ-পরামর্শ-বিবৃদ্ধমন্যোভ্রূর্ভঙ্গ-দুষ্প্রেক্ষ্য মুখস্য তস্য।
স্ফুরন্ন দর্চ্চিঃ সহসা তৃতীয়াদক্ষ্ণঃ কৃশানুঃ কিল নিষ্পপাত।।
ক্রোধং প্রভো! সংহর সংহরেতি যাবদ্ গিরঃ খে মরুতাং চরন্তি।
তাবৎ স বহ্নির্ভবনেত্রজন্মা ভস্মাবশেষং মদনং চকার।।“
ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় ক্রোধে রুদ্রের তিন চোখই ধক্-ধক্ করে জ্বলতে থাকল। সে চোখের
দিকে তাকায় কার সাধ্য। হঠাৎ তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে বেরিয়ে এল ভয়ংকর আগুন; মুহুর্তে
ভস্মীভূত হয়ে গেলেন মদন। এতক্ষন মদনের পরামর্শ দাতা দেবতারা আড়ালে আবডালে
উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। মদন তো গেল- দেখে ভয়ে তারা সবাই শিবকে বলতে থাকলেন – হে
প্রভু! ক্রোধ সংবরণ কর, সংবরণ কর।
একবার ভাবুন অবস্থাটা- সৃষ্টি আছে অথচ কাম নেই। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে কে কি
বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হত। শিবের কারনেই তাঁকে সে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে
হয়নি। মদনের স্ত্রী রতির তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব মদনকে পুনর্জীবন দান করেন,
কিন্তু গোল বাধে অন্য জায়গায়। শিবের নয়ানের আগুনে ভস্মীভুত দেহ ফিরিয়ে দেওয়া
শিবেরও অসাধ্য। দেহহীন মদন। শিব তাকে অধিকার দিলেন সমস্ত জীবের মনে বাস করার। মদন
হলেন মনসিজ। এতোদিন তাকে বাইরে থেকে তির ছুঁড়ে হৃদয়ের আক্সেস (access) নিতে হচ্ছিল, এবার
মনের ভিতরে বসেই কারিকুরি করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। ভাইরাস বাইরে ছিল বাসা বাঁধল
সিস্টেমের বুট সেক্টরে। এর পরেও সৃষ্টির
দেবতা ব্রহ্মার চাকরিটি যে আছে এই অনেক।
বিশ্বনাথ দর্শনের লাইন দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ; ছয় থেকে আট ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে
হবে দর্শন করতে। দুদিন আগে প্রয়াগে মহাকুম্ভের শাহী স্নান ছিল। সঙ্গমে ডুবকি লাগিয়ে কয়েক লক্ষ তীর্থযাত্রী হাজির
হয়েছে কাশীতে, বাবা বিশ্বনাথ দর্শন করে পূণ্যের ঘড়া পূর্ণ করতে। আমি তীর্থস্থানে
ঘুরে বেড়াই মানুষকে দেখতে- জানতে, পাপ-পূণ্যের অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট ব্যালান্স
রাখতে নয়। অগত্যা
বিশ্বনাথ দর্শনের আশা ছেড়ে হাজির হলাম দশাশ্বমেধ ঘাটে। নদী আমাকে পাগলের মত টানে,
সে বাঁকুড়ার ক্ষীনকায়া ভৈরব বাঁকি, বসিরহাটের ইছামতি বা কাশ্মীরের লিডার যেই হোকনা
কেন। স্কুলে নদী শব্দের পুংলিঙ্গ লিখতাম নদ। বড়োহয়ে যখন নদীর প্রেমে পড়েছি মনে
হয়েছে নদ কথাটা ব্যাকরণে ঠিক হলেও আসলে ভুল। নদীর মধ্যে যে রহস্য, যে শক্তি, যে
ভাঙাগড়া, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে রুপান্তরের যে ক্ষমতা থাকে তা পুরুষের হতেই
পারে না। আমার সামনে গঙ্গা, ভারতীয়
সভ্যতার জননী। অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী আদি শঙ্করাচার্য অনেক লিখেছেন কিন্তু দেবদেবীদের
কোনো স্তব গাথা লেখেননি; ব্যাতিক্রম দুটো- ‘গঙ্গা স্তোত্রম’ আর ‘অন্নপুর্না
অষ্টকম্’। গঙ্গা আর অন্নপুর্না উভয়েরই শহর এই কাশী। অন্নপুর্না একবার শিবকে ত্যাগ
করেছিলেন, শিবঠাকুরের ভিক্ষেও জুটছিল না। অবশেষে শিব কাশীতে দেবী অন্নপুর্নার
আশ্রয় নেন। স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝি মিটেছিল আর শিব বেঁচেছিলেন দুর্ভিক্ষের
(ভিক্ষার অভাব) হাত থেকে। আর গঙ্গা; কয়েক হাজার বছর ধরে কাশীতে নদীর গতি পথ একই।
এখানে তার ভাঙাগড়া নেই। ভৌগলিক কারন জানিনা। লোককথা- কাশী স্বয়ং শিবের বাস, গঙ্গা
তাই এখানে শান্ত।
ঘাটের সিঁড়িতে শীতের রোদ গায়ে মেখে অলস সময় কাটাচ্ছি। সামনে কলুষিতা
সুরেশ্বরী- ফুল, মালা, মানুষের শ্লেষ্মা, পোড়া কাঠ, প্লাস্টিক- কি নেই তার বুকে।
এদিক ওদিক তাকালাম, দূরে নজরে পড়ল চৌকির ওপর আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে এক
ব্রাহ্মণ, চৌকির পায়ায় বাঁধা এঁড়ে বাছুর। ভব বৈতরণী পার হওয়ার শর্টকাট। সনাতন
ভারতীয় ধর্ম বা দর্শন পাপ-পূণ্য কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, অথচ ধর্মপালনে এতো
শর্টকাট কোথা থেকে এলো বুঝতে পারিনা।
হঠাৎ বোধহয় বাবা বিশ্বানাথের কানে খবর গিয়েছিল তাঁর দর্শনপ্রার্থী আমরা তিনটি প্রমথ দশাশ্বমেধ
ঘাটে অপেক্ষা করছি। তাই এল ‘বুলাওয়া’। দশাশ্বমেধ
ঘাট ধোওয়া হবে, আমাদের তাই উঠতে হবে। ঘাট থেকে বেরিয়ে ইতি উতি ঘুরছি। একটা গলিতে
ঢুকতে যাব, সার দিয়ে থাকে দোকান গুলো থেকে কিছু মেমেন্টো কিনব। পুলিশ ঢুকতে দেবেনা।
কারনটা পরে বুঝেছিলাম; আসলে ওই গলি দিয়ে ঢুকলে আমরা খুব সহজেই পৌঁছে যাব বিশ্বনাথ
মন্দিরের গর্ভগৃহে। যাইহোক অনেক কৌশল করে ঢুকলাম সেই গলিতে। সার সার দোকান, আমরা
দেখতে দেখতে হাঁটছি। হঠাৎ খুব আস্তে গলায় ‘দর্শন করনা হ্যায় তো ইঁহা জুতা মোবাইল
রাখকে যাইয়ে।‘ দেখি এক প্রসাদের ডালি বিক্রেতা। - “দর্শন তো করনা হ্যায়, লেকিন
লাইন মেঁ আট ঘন্টে খাড়া রেহনা পড়েগা।“
এরপর লোকটির সাথে আমার কিছু কথোপকথন। ব্যাগ, জুতো, মোবাইল, মানিব্যাগ সব ওর
দোকানের লকারে রেখে ওখান থেকেই পূজার ডালি কিনে বেরোলাম। দোকানদারের একটি ছেলে
আমাদের নিয়ে কাশীর বিখ্যাত গলিঘুঁজি ঘুরিয়ে পৌছে দিল ওই আটঘণ্টার লাইনের একেবারে
মাথার দিকে। ‘কিসি তরহ ঊস লাইন মে ঘুস যাইয়ে।‘ একটু ঘাবড়ে গেছি। ইউপি পুলিশের লাঠি
বাঁচিয়ে বিস্তর দেহাতি গালাগালি সহ্য করে লাইনেও ঢুকে গেলাম। তারপর দশ মিনিটের
মধ্যে বাবা বিস্বনাথের সামনে। ভালকরে দেখতে না দেখতেই আমাকে কেউ পালকের মত টেনে
সরিয়ে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক সি আর পি এফ তনয়া। গর্ভ গৃহে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের
টেনে সরিয়ে দিচ্ছে যাতে ভিড় জমে না যায়। মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম কিছুক্ষন।
নব্বই কিলো ওজনের ছ-ফুটিয়া আমাকে ওইভাবে টেনে কোন নারী সরাতে পারে, মুগ্ধ না হয়ে
উপায় ছিল না। আট ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আধ ঘণ্টায় দর্শন শেষ। উপায় সেই
শর্টকাট।
কিছু মেমেন্টো কিনে, খাবার খেয়ে আবার দশাশ্বমেধ ঘাট। বেলা পড়ে এসেছে। সন্ধ্যায়
গঙ্গারতি দেখব। শিবের সাথে গঙ্গা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। মর্ত্যে শিব গঙ্গাকে প্রথম
ধারণ করেছিলেন। শিবের জটার মধ্য দিয়ে গঙ্গা মর্ত্যে এসেছেন। লৌকিক দেবতা হিসেবে
শিব কৃষির দেবতা, যে প্রতীকে তিনি পুজিত হন তা সৃষ্টির দ্যোতনা বহন করে, তাঁর বাহন
নন্দী (ষাঁড়); কৃষিকার্যে যা অপরিহার্য্য। গঙ্গা এই ভারত ভূমিকে ( উত্তর ভারত)
উর্বরতা দিয়েছে। গঙ্গা ছাড়া এখানে সভ্যতা গড়ে উঠত না। শিব হলাহল কে ধারন করতে
পেরেছিলেন কিন্তু গঙ্গা তা পারবেন না। সভ্যতার হলাহল পান করতে করতে গঙ্গা একদিন
মর্ত্যলোক ছেড়ে বিদায় নেবেন। পুরাণেও আছে কলির শেষে গঙ্গা স্বর্গলোকে ফিরে যাবেন।
গঙ্গারতি শুরু হল। সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্য। আরতির মন্ত্র শুনতে শুনতে চোখ
বুজেছিলাম। চোখের সামনে ভেসে এল
গঙ্গাহীন ভারতবর্ষের ছবি। ধূ ধূ মরুভুমি। শিবকেউ
খুঁজে পেলাম না।
আরতি শেষ হল। এবার ফেরার পালা।
No comments:
Post a Comment