Scrolling Text

ট্রাভেল ক্লাবে আপনাকে স্বাগত। আপনার বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিন সবার সাথে। লেখা ও ছবি পাঠাতে ক্লিক্‌ করুন Contact Us ট্যাবে।

Tuesday, 8 May 2012

HONEYMOON IN KUMAYUN


অনন্য কুমায়ূন – অসাধারণ হানিমুন 
 পঙ্কজ হাজরা ও সুমনা হাজরা রক্ষিত
Nainital Lake, Nainital
   প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির এই রঙ বদলের বহুরূপী খেলা কোনদিন যে দেখতে পাব ভাবিনি। বর্ধমান  স্টেশন- এর রিজার্ভেসনের লম্বা লাইনে তখন জানিনা যাত্রা নিশ্চিত কিনা। ২০১১ সালেরএপ্রিল মাসে যাত্রা স্থির হলেও টিকিট কাটাই হল প্রায় দুমাস আগে এবং শুরু হল হোটেল বুক করার জন্য নির্ভরযোগ্য সংস্থার খোঁজউত্তরাখণ্ড সরকারের কুমায়ূন মণ্ডল বিকাশ নিগম লিমিটেড (Kumayon Mandal Vikash Nigam Ltd.) এর বিশ্বাসযোগ্যাতায় ভর করে হোটেল বুকিং সাঙ্গ হল। ভ্রমনের আনন্দ যাতে নিরানন্দ না হয়ে যায় সে জন্য আমাদের নৈনিতাল (Nainital) ও কৌশানি (Koushani) যাত্রার পরিকল্পনা করা হল রাজধানীর পথ ধরে। হ্যাঁ, পণ্ডিতদের পরামর্শ  উপেক্ষা করে লক্ষ্ণৌ এর পথ না ধরে দিল্লীর পথই ধরলাম। বর্ধমান স্টেশন থেকে পূর্বা এক্সপ্রেসের side upper & lower সিট দুটি এই দম্পতির অস্থায়ী সংসারে পরিণত হল। কচিকাঁচাদের শিশুসুলভ আচার আচরণ দেখতে দেখতে কখন যে পাটনা-মুগলসরাই পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। রেলকোচের মৃদু আলোয় কিছুটা ম্যাগাজিন পড়া ও কিছুটা গান শোনায় যাত্রা ক্লান্তি দূর হল। দুপুরের অভুক্ত বাড়ীর তৈরি ফ্রায়েড রাইস ও চিলি চিকেন দিয়ে আমরা আমাদের রাত্রের আহার সাঙ্গ করলাম। আস্বাভাবিক কোনো উপদ্রব ছাড়াই ঘুম ভাঙ্গল আলিগঢ় স্টেশনেনির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট পরে দিল্লী স্টেশনে পৌঁছে পুরানো দিল্লীর নির্ধারিত হোটেলে আমরা উঠলাম। সেখানে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি দূর করে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হল রাত ১০-টায়। রানিক্ষেত এক্সপ্রেসে সময়ের স্বল্পতার কারনে সংসার পাতা সম্ভব হল না । সঠিক সময়ে কাকভোরে কাঠগোদাম স্টেশনে পৌঁছে শুরু হল এক অদ্ভুত ভাল লাগা। চতুর্দিকে ছোট ছোট পাহাড় পরিবৃত উত্তরাখন্ডের এই সাজানো গোছানো স্টেশন ও তার মনোরম আবহাওয়া মুগ্ধ করে দেবার মতনসুর্যরশ্মির পৃথিবীতে আগমন ও আমাদের নৈনিতাল যাত্রা তালে তাল মিলিয়ে চলতে লাগল। খোঁপার কাঁটার অনুরূপ বাঁকের রোমাঞ্চ এবং একদিকের গভীর খাদের অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে অবশেষে আমরা নৈনিতাল পৌঁছালাম। হোটেলে চেক-ইন এর সময় দুপুর বারোটা হলেও ম্যানেজারের এর সৌহার্দ্যপূর্ণ সহযোগিতায় সকাল সাড়ে ছ-টায় আমরা রুম পেয়ে গেলাম। একটি রাতের ব্যবধানে আবহাওয়ার আমূল পারিবর্তনে স্বভাবতই মনটা ভরে গেল। ঠাণ্ডায় প্রায় থরহরি কম্পমান হয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতি দর্শনে। 




শুধুমাত্র একটি লেককে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প যে এইভাবে বিকশিত হতে পারে সেটা নৈনিতাল স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ম্যাল বরাবর হাঁটতে থাকলাম লেককে বাঁদিকে রেখে। রিক্সা ব্যাতিত অন্য যানের অনুমতি নেই ম্যালে । রাস্তার পরিবেশ এতটাই মনোরম যে ১১ নম্বর ছাড়া অন্য যানের কথা মনেই পরবে না। বিনোদনের পসরা সাজিয়ে স্থানীয় ব্যাবসায়ীদের সারিবদ্ধ দোকান এই ম্যাল জুড়ে আর আছে অলকা ও ক্লাসিকের মত ঝাঁ চকচকে হোটেল। পকেটে রেঁস্ত কম থাকায় এগুলির কথা আর ভাবলাম না। ভ্রমনের বই থেকে বাঙালি হোটেল মৌচাক সহজে খুঁজে পেয়ে গেলাম এবং বেশ তৃপ্তি করেই দুপুরের ভোজন পর্ব সমাপণ হল। লেকের জলে রঙ-বেরঙের পাল 
Nainital

তোলা ইয়াচিং বোটগুলি ইতস্তত ঘোরাফেরা লেকের ধারে বসে উপভোগ করতে লাগলাম। টুকিটাকি ঘর সাজাবার সামগ্রী ক্রয় করে নৈনিতালের বিখ্যাত একটি রেঁস্তোরায় মোমোর স্বাদ উপভোগ করে দিনান্তে হোটেলে ফিরলাম।হোটেলের লেক ভিউ ব্যালকনিতে বসে দেখলাম রাতের নৈনিতাল যেন এক তারকা খচিত ছায়াপথ। পরদিন স্থানীয় ট্যুর সংস্থার বাসে অন্যান্য লেক ভ্রমন পর্ব সারলাম। 
Nainital

সাততাল, ভীমতাল, নউকুচিয়াতাল –তিনটি লেকই নৈনিতালের তুলানায় আকারে বড়লেকগুলির সৌন্দর্য্য খুব খারাপ না হলেও মন পরে রইল নৈনিতালের দিকেই। হোটেলে ফিরে পুনরায় বিনোদনের জগতে সান্ধ্যপর্ব শুরু করলাম। এদিনও মোমোর স্বাদকে সঙ্গী করে হোটলে ফিরে এলাম। 
Baijnath

 পরদিন সাকালে প্রাতঃরাশ সেরে কৌশানির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথে পরল কাঞ্চি বাবার আশ্রম। পাহাড় ও নদীর আনুগত্য ও ভালবাসায় লালিত পালিত এই আশ্রম পথের প্রায় প্রতিটি পর্যটককে হাতছানি দেয়। প্রকিতির শোভা উপভোগ করতে করতে পৌঁছালাম রানিখেত। ভারতের প্রথম পরমবীর চক্র সোমনাথ শর্মার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত সোমনাথ সৈনিক পার্ক দেখলাম। রাস্তার মধ্যে শুরু হওয়া বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে গাড়ি থেকে নামলাম রানিক্ষেতের বিখ্যাত গল্ফকোর্স দেখতে। এক অনন্য সাধারণ উপত্যকা পেরিয়ে যখন কৌশানি পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর সাড়ে তিনটে। প্রকৃতির মুখ ভার তাই আমাদেরও মন ভার হয়ে গেল। ভারতীয় খাবার আর মিলল না, তাই চীনের খাবার চাউমিনকে উপজীব্য করে আমরা আবার বেরিয়ে পরলাম মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত গান্ধী আশ্রমের উদ্দেশ্যে। মেঘ এবং ধোঁয়াশা সরিয়ে অনতিবিলম্বেই অস্তগামী সূর্যের দেখা মিলল। সাথে সাথেই শুরু হল অবাক হওয়ার পালা । একে একে দৃশ্যমান হতে লাগল ত্রিশুল, নন্দাদেবী, নন্দাঘূণ্টী ,মৃগথূণী, চৌখাম্বা,পঞ্চচূল্লী শৃঙ্গগুলিক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হতে লাগল শৃঙ্গরাজির রূপ। স্থানীয় লোকজন আশ্বস্ত করলো পরদিন সকালে নাকি খুব সুন্দর অবাক করে দেওয়া সকাল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মনে আশা এবং অঙ্গে দুটি কম্বল জড়িয়ে নিদ্রাদেবীর আহ্বানে সাড়া দিলাম। মোবাইল-এ অ্যালার্ম দেওয়াই ছিল,তাই পূর্ব নির্ধারিত সময় ভোর পাঁচটাতেই ঘুম ভাঙল। হোটেলের ব্যালকনির দরজা খুলতেই ঘুম ঘুম চোখে যেন একটা শিহরণ জেগে উঠল। সামনের শৃঙ্গরাজি তার আলো আঁধারি রূপ নিয়ে সামনে ভীষণ ভাবে প্রকট হল। ধীরে ধীরে পঞ্চচূল্লী শৃঙ্গরাজির পিছন 
Sunrise at Koushani

থেকে সূর্যরশ্মির আবির্ভাব শুরু হল এবং তার প্রথম আলোর প্রতিফলন ঘটল ত্রিশুলের প্রথম খাঁজের উপর। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ধীরে ধীরে অন্যান্য শৃঙ্গগুলিও ত্রিশুলের কাছে আলোক রশ্মির অংশ কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে লাগলএই দৃশ্য দেখে আমরা যখন প্রায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় ততক্ষণে স্থানীয় জনগণের দৈনন্দিন কাজকর্ম প্রায় অর্ধসমাপ্ত প্রকৃতির এই অসাধারণ রূপ তাদের কাছে যেন শিশুসুলভ আচরণ মাত্র। প্রকৃতির এই রূপ ও রস আকণ্ঠ পান করে একে একে স্নানের জন্য প্রস্তুতি নিলাম কারণ – আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বৈজনাথ মন্দির। পূর্বনির্ধারিত সময়মত সকাল ৯ টায় গাড়ি হাজির। রওনা দিলাম বৈজনাথের উদ্দেশ্যপথে পরল এক অসাধারণ সুন্দর চা বাগান—ক্ষণিকের বিরতি –ফটোশুট এবং আবার রওনা।
Baijnath

গোমতীর তীরে এক ছোট্ট জনপদ বৈজনাথ। বরফের শৃঙ্গরাজী এখান থেকেও সুন্দর দৃশ্যমান। বৈজনাথের মন্দিরগুলির আকার আয়তন খুব বড়ো না হলেও দৃশ্যমানতায় অনেক নামী মন্দিরকেও হার মানিয়ে দিতে পারে। মন্দির দর্শন সাঙ্গ করে হোটেলে ফেরা এবং লাঞ্চ সেরে দুপুরের বিশ্রাম। দুপুরের পর থেকে আকাশের মুখ ভার, সুতরাং সূর্যাস্তের স্বাদ এদিন আর নেওয়া গেল নাবিকালবেলাটা হোটেলের চারিদিকে ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দিলাম। খিচুড়ি ও ডিম ভাজা সহযোগে ডিনার সেরে আমরা ঘুমোতে গেলাম। পরদিন সকালে সূর্যোদয় দেখার আশা নিয়ে যথারীতি কাকভোরে ঘুম থেকে উঠলাম, কিন্তু নিরাশই হতে হল। অবশ্য সেই অর্থে নিরাশ বলব না কারণ আমরা ততোক্ষণে কাঁচ এবং কাঞ্চনের পার্থক্য উপলব্ধি করেছি। আগেরদিনের সূর্যোদয় যদি কাঞ্চন হয় আজকের টা অবশ্যই কাঁচ। যাই হোক আলো আঁধারি মেঘে ঢাকা সূর্যোদয় পর্ব শেষ করে প্রাতঃরাশ সারলাম। সময়ের স্বল্পতায় ও বাড়ির টানে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমাদের ভ্রমণ পর্বের উপসংহার টানলাম। আমাদের ফিরতি যাত্রাপথ নৈনিতালকে ছুঁয়েই। এক অসাধারণ সুন্দর রোমান্টিক হানিমুনের স্মৃতি নিয়ে এবং পুনরায় আসার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।   

No comments:

Post a Comment