Scrolling Text

ট্রাভেল ক্লাবে আপনাকে স্বাগত। আপনার বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিন সবার সাথে। লেখা ও ছবি পাঠাতে ক্লিক্‌ করুন Contact Us ট্যাবে।

Saturday, 28 February 2015

BHIMBETKA



 বিবর্তন

পুরনো ইতিহাসের পথে- ভীমবেটকা
ভারতের মধ্যাঞ্চলের বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তরাংশে প্রস্তর যুগের নিদর্শন যা আবিষ্কৃত হয়েছে তা সমগ্র বিশ্বকে অবাক করেছে। বাধ্য করেছে গোটা পৃথিবীর মানুষকে আর একবার শ্রদ্ধার সাথে ভারতের পুরনো সভ্যতার দিকে ফিরে তাকাতে।
পাথুরে পর্বতের খাড়া ঢালে অবস্থিত ঘন বনাঞ্চলের ভিতর প্রায় ৬০০ টি গুহা ১৯৫৭ সালে আবিষ্কার হয়েছে যেগুলি
প্রাগৈতিহাসিক কালে্র (prehistoric age)  মানুষ বসবাসের জন্য ব্যাবহার করত। সারা পৃথিবীতে এর সমসাময়িক যা কিছু নিদর্শন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে তাদের মধ্যে এই গুহা সমষ্টিই (cluster)  সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ। মানব সভ্যতার অগ্রগতির
ইতিহাসের এক অমুল্য আখ্যান এখানকার পাথুরে
গুহাগুলির ভিতর অঙ্কিত হয়ে আছে। এই কারনে ইউনেস্কো (UNESCO)  এই স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ঘোষণা করেছে।

ভুমিক্ষয়
ভূপাল শহর থেকে মাত্র ৪৬ কিমি দূরে অবস্থিত। শহর ছাড়ানর খানিক বাদ থেকেই শুষ্ক রুক্ষ প্রকৃতি সঙ্গ নেবে। যতো এগোবেন ততোই রুক্ষতা বাড়তে থাকবে। এই অঞ্চলের পাহাড়গুলি অতি শক্ত নাইস জাতীয় রূপান্তরিত শিলা দিয়ে মূলত গঠিত। কালের নিয়মে এর মাঝে থাকা অপেক্ষাকৃত নরম শিলাস্তর ক্ষয় পেয়েছে। স্কেলিং হয়েছেসব মিলিয়ে ক্ষয়জাত পর্বতের আদর্শ চিত্র। এর মাঝেই আছে ঘন বনাঞ্চল। স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেলা বাড়লেই রোদের তাপও তীব্র। স্পটে পৌঁছানর পর গাড়ি রেখে এগোতে হবে।
টিকিট করার পর গাইডের খোঁজ করুন। নিজেরা ঘুরতে পারেন অবশ্যই। কিন্তু তাতে দেখা সম্পূর্ণ না হতেও পারে। কারন ৬০০ টি গুহার ভিতর প্রায় ৫০০ টিতে চিত্র পাওয়া গেছে। সামনের দিকের কিছু গুহা পর্যটকদের জন্য খোলা আছে। বাকি এখনও গহীন জঙ্গলের ভিতরে এ এস আই (ASI)  এর তত্বাবধানে সুরক্ষিত আছে। কারন মনুষ্য পদধুলি পড়তে শুরু করলেই কালক্ষয় তরান্বিত হতে বাধ্য। উপযুক্ত শিক্ষিত গাইড না পেলে সমস্ত চিত্র খুঁজে পাওয়া এবং তাদের কাল বৈশিষ্ট্য বোঝা ভালোই মুশকিল হবে।
গুহাগুলিতে মোট তিনটি যুগের চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রস্তর যুগ (Pre historic Age to Stone Age) : এর তিনটি অংশঃ
ক) (Period I) প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষাংশ (Upper Palaeolithic):-  এই সময়কালীন চিত্র গুলি সরলরৈখিক (linear) মূলত সবুজ ও ঘন কালচে লাল রঙ দিয়ে আঁকা। প্রধানত জন্তু জানোয়ারের ছবি। আকারও বড়। বাইসন, গণ্ডার ও বাঘের চিত্র পাওয়া গেছে। গাইড ভালো না হলে চিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য দেখে বাইসন ও গণ্ডার আলাদা করা হচ্ছে বুঝতে পারবেন না।

প্রাকৃতিক হলুদ সাদা রং এর ব্যাবহার
 খ) (Period II) মধ্য প্রস্তর যুগ (Mesolithic):-  সময়ের সাথে হাতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় অঙ্কনে সূক্ষ্মতা আসতে শুরু করলো এটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। চিত্রের আকার ছোট। পশুর সাথে মানুষের শরীর আঁকা হচ্ছে। সরলরৈখিক হলেও শরীরের খাঁজ দেখা যাচ্ছে। বিষয়েও বৈচিত্র্য এসেছে। তীর ধনুক, বর্শা, গয়না, শিকার দৃশ্য, একসাথে নাচ, মৃত পশু টেনে আনা, মা ও শিশু, এমনকি গর্ভবতী মহিলার চিত্রও পরিস্কার বোধগম্য হবে। পাখির চিত্র প্রমান করে তখনকার মানুষ আকাশে উড়ন্ত জীবকে লক্ষ্য করে আঁকতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময়ের পৃথিবীর কিছু স্থানে যা কিছু মনুষ্য সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে তার সাথে তুল্যমূল্য বিচারে এগুলির গঠন শৈলী, পর্যবেক্ষণ, হাত ব্যাবহারের দক্ষতা, অস্ত্রের বিভিন্নতা এবং চিন্তাশক্তি অনেক গুন উন্নত।
গ) (Period III) নবীন প্রস্তর যুগ (Neolithic & Chalcolithic):-  এই সময়কালীন কয়েকটি সভ্যতার নিদর্শন পৃথিবীর আরও কিছু দেশে পাওয়া গেছে। আমাদের দেশেও উত্তরাংশে উদ্ভব হুয়েছে এক উন্নতা সভ্যতারদক্ষিণ অংশেও মালয় উপত্যকা ও সমভূমিতে অনান্য শ্রেণীর মানুষেরা তখন গুহা জীবন পেরিয়ে কৃষিজীবীতে পরিণত হয়েছে। এই সময়কার চিত্র গুলি প্রমান করে যে এই অঞ্চলের গুহাবাসী মানুষরা এই সময় মালয় সমভুমির কৃষিজীবী মানুষদের সংস্পর্শে এসেছিল এবং কিছু পরিমানে আদানপ্রদানও শুরু করেছিল। কি জানি, হয়ত তখন থেকেই সমভুমির মানুষরা এদের বন্য বা রাক্ষস শ্রেণিতে ফেলেছিল!

যূথ বদ্ধ নাচ, সরল রৈখিক চিত্র
ঘ) (Period IV & V)  ইতিহাসের প্রথম পাঠ (Early Historic) :-   এই সময়ের চিত্র দেখার সময় মনে রাখতে হবে বাইরের জীবনযাত্রা ও সভ্যতা কিন্তু এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ তখনও বনের উপরই নির্ভরশীল এবং গুহাবাসী, কৃষিজীবী মূলত নয়। চিত্র গুলি অনেক বেশী সাজানোগোছান। আগের ধরন ও বিষয় বস্তুর সাথে নতুন সংযোজন, লেখার ভাষা (script) যা আজও পাঠ করা যায়নি। এছাড়াও প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করা হত দেখা যায়। গাছকে অর্চনা করার চিত্র দেখতে পাবেন। এই সময়ের আর দুটি নতুন জিনিষ হল সাদা ও হলুদ রঙের ব্যবহার এবং বাইরের রেখাচিত্র আগে এঁকে নিয়ে (outline drawing) রঙ দিয়ে ভরাট করা।  অনেক জায়গাতেই দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ের ছবির পাশাপাশি সহাবস্থান, যা প্রমান করে একই গুহা, বংশ বা যুগ পরম্পরায় ব্যবহৃত হচ্ছিল। অনেক ক্ষেত্রে পুরনো ছবিকেই ক্যানভাসের মত ব্যাবহার করে তাদের উন্নত করা হয়েছে। আবার কোথাও আগে পাথরের দেওয়ালকে সাদা রঙ দিয়ে ভরাট করে ক্যানভাস বানানো হয়েছে। তার উপর রঙ দিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে।
ঙ) (Period VI & VII)  মধ্য যুগ (Medieval Age):-  চিত্র আবার আগের মতই সরলরৈখিক হতে শুরু করে। সূক্ষ্মতার পরিবর্তে শৈলী ও চিন্তাধারায় স্থুলতা এসে যায়। তবে নতুন জিনিস হল জ্যামিতিক আকারের প্রবেশ।    এই যুগের ছবি প্রমান করে বহির্জগতের সাথে পুরোমাত্রায় যোগাযোগ না রাখার কারনে এই গুহাবাসী মানুষেরা বাইরের মানুষদের তুলনায় সভ্যতার অগ্রগতির মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। হয়ত এরাই পরবর্তী যুগে তথাকথিত আদিবাসীতে পরিনত হয়। অবশ্য ইতিহাস সাক্ষী এরাই আমাদের আদি বাসী।

শিকার দৃশ্য
প্রাকৃতিক রঙের সাথে পশুর চর্বি মিশিয়ে রঙ তৈরি করা হয়েছিল যা আজও মলিন হয়নি। এটা একটা বিরাট বিস্ময় বইকি। ম্যাঙ্গানিজ, হেমাটাইট, নরম রেড স্টোন, চারকোল, চুন, পাতা ও ফুলের নির্যাস, কাঠকয়লা ইত্যদি মূলত ব্যবহৃত হতো।
কারা যাবেনঃ চারপাশের প্রকৃতি রুক্ষতার মধ্যেও অসাধারন সুন্দর। প্রকৃতি প্রেমিরা জায়গা বেছে বেড়ান না। তারা তো রসসুধার কাঙ্গাল। পাহাড়ের ঢাল বা ক্লিফ একেক জায়গায় অসাধারন প্রাকৃতিক ভাস্কর্য তৈরি করেছে। এর মধ্যে একটি ঝুলন্ত কচ্ছপ অবশ্যই দেখবেন। সুনীল আকাশের নীচে ঘন কালো ও হলুদ বর্ণের পাহাড়, ঘন সবুজ বনাঞ্চল আলোকচিত্রিদের জন্য পশরা সাজিয়ে বসে আছে। ছাত্রদের শিক্ষামূলক ভ্রমনের জন্য এটি আদর্শ স্থান। একাধারে ভূগোল ও ইতিহাসের হাতে কলমে পাঠ নেওয়া যাবে। পক্ষী প্রেমীদেরও ভিম্বেটকা নিরাশ করবেনা। বন থেকে তীক্ষ্ণ কর্কশ সুরেই হোক আর মিঠে সুরেলা আওয়াজ তুলেই হোক, বেরিয়ে এসে নিশ্চিন্তে ন্যাড়া পাথরের উপর বসে নীলের ব্যাকড্রপে অসাধারন পোজ দেবে।

প্রাকৃতিক ক্ষয়ের ফলে কাছিমের রূপ নেওয়া শিলা  
সাবধানতাঃ  শুধু ভ্রামনিকদের কাছে নিবেদন, দয়া করে গুহা গাত্রে নিজ নাম খোদাই করা লোক দেখলে বাধা দেবেন, জলের বোতল, চিপ্সের প্যাকেট ফেলতে দেখলে বাধা দেবেন এবং যে গুহাগুলিতে প্রাকৃতিক আলো আসেনা সেখানে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহারে বাধা দেবেন। ভাবার প্রয়োজন নেই যে এগুলি কর্তৃপক্ষের কাজই শুধু। না। এগুলি আপনার আমার যৌথ দ্বায়িত্ব। তবেই ভিম্বেটকা বেঁচে থাকবে আরও লক্ষ বছর।
যাওয়াঃ ভূপাল শহর থেকে ৪৬কিমি দূর। প্রচুর বাস আছেতবে সেক্ষেত্রে নেমে কিছুটা হাঁটতে হবে। নাহলে নিজ বাহনই ভরসা। অনায়াসে অটো রিসার্ভ করেও যাওয়া যেতে পারে।।
কখন যাবেনঃ  সারা বছরই যাওয়া যায়। তবে জুন মাসে অতিরিক্ত বর্ষার কারনে ঘোরা সমস্যা হতে পারে। মার্চ, এপ্রিল, মে তে রোদ অসম্ভব তীব্র। শীতকাল সেরা সময়। ব্যাকপ্যাকারদের তো অসময় ও সময়। তাই যাওয়া স্ব মর্জি মাফিক।
থাকাঃ  না থাকলেও চলে। সকালে ভুপাল থেকে বেরিয়ে সারাদিন ঘুরে ভুপালে ফিরে আসতে পারেন। চাইলে একই রাস্তায় ভোজপুর ঘুরে নিতে পারেন। (সে গল্প পরের দিন করা যাবে।) আর থাকতে চাইলে একমাত্র জায়গা ভিম্বেটকা হাইওয়ে ট্রীট, মধ্য প্রদেশ পর্যটনেরদারুন সুন্দর সাজানো ও আরও সুন্দর প্রকৃতির মাঝে অবস্থান।

গাইড অজয় সিংহ চৌহান
আহারঃ  কোন খাবার দোকান নেই। ছোট গুমটি আছে, জল ও চিপস ছাড়া কিছু পাবেন না। হয় প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে যান আর নয় যাওয়া বা আসার পথে রাস্তার ধারের স্থানীয় হোটেলে খাওয়া সারুন। আর নিজেদের সাথে গাড়ি থাকলে প্রথমে পৌঁছে হাইওয়ে ট্রীটে গিয়ে খাবার অর্ডার করে স্পটে যান এবং ফিরে এসে খাওয়া সারুন।
গাইডঃ টিকিট কাটার পর গাইডের খোঁজ করতে হবে। একজনের হদিশ দেওয়া হল। চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। ছেলেটি এম বি এ পাস। বেরানর শখে ট্যুর অপারেটরের কাজ করে। খুব সুন্দর ভাবে দেখাবে সবকিছু। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য এই ছেলেটি এম পি গভমেন্টের রেজিস্টারড ট্যুর অপারেটর। হোটেল, কার সবই বুকিং করতে সাহায্য করে।
অজয় সিং চৌহান। (Ajay Singh Chouhan) +৯১৮৯৮২১৪০৭৬৮ (মোবাইল), ajay8855@yahoo.com (ই মেল)
House No. 4, J. P. Hospital Campus, Tulsi Nagar, Bhopal, M. P. India

No comments:

Post a Comment