মিষ্টির টানে ফিরে দেখা
মদনমোহনের দোলযাত্রা
|
দোল বা হোলিতে আমরা অনেক জায়গায় অনেক কারনে বেড়াতে
যাই। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে, কোথাও বা আকাশ লাল করা শিমুল পলাশ দেখতে, কখনোও বা
দুদিনের ছুটি কাটাতে বেড়িয়ে পড়ি। এবার সবান্ধবে পাড়ি দিলাম আমার নিজের দেশের বাড়ি,
দোল উৎসব দেখতে। আর হ্যাঁ মিষ্টি দেখতে আর খেতে।
অতিকায় মিস্টি
|
বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী থেকে ৮কিমি ভিতরে
দোগাছিয়া গ্রাম। এই গ্রামের সবচেয়ে বড়ো উৎসব হল দোলযাত্রা। এখানে এই উৎসব পূর্ণিমার
দিন থেকে শুরু হয়ে পালিত হয় চারদিন ধরে। উৎসব শুরুর আগের দিন রাত্রে ন্যাড়া পোড়া
দিয়ে এর সূচনা। একটি বিরাট
বাঁশ ও খড়ের কাঠামো তে প্রচুর বাজি বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর গ্রামের মূল উৎসব প্রাঙ্গনে এটিতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। এরপর প্রতিদিন রাত্রেই এটি চলতে থাকে।
বাঁশ ও খড়ের কাঠামো তে প্রচুর বাজি বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর গ্রামের মূল উৎসব প্রাঙ্গনে এটিতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। এরপর প্রতিদিন রাত্রেই এটি চলতে থাকে।
এই উপলক্ষে এখানে একটি বড়ো
মেলা বসে, গ্রামীণ মেলা। রোজ রাতে প্রথমে স্থানীয়দের জলসা
এবং পরে যাত্রা হয়। মেলা
বসার আগে থেকে এখানে তাঁবু খাটিয়ে ভিত গাড়েন হালুইকররা। হ্যাঁ, যা আমরা শহুরে
লোকেরা ভুলতে বসেছি। নতুন প্রজন্ম তো দেখেইনি। এখানে সারারাত ধরে মিষ্টি বানানো
চলে। কড়া পাকের রস জ্বাল দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির মিষ্টি বানানো হয় যার রঙ প্রায়
লালচে। কিন্তু কোন রঙ বা খেজুড় গুড় দিয়ে নয়। আর এই মিষ্টি ফ্রিজ ছাড়াই অন্তত
সাতদিন একই ভাবে থেকে যাবে। এক একটি মিষ্টি আপনার এক হাতের সমান লম্বা বা গোল হলে
আপনি পুরো হাতে নাও ধরতে পারেন। আমরা খুব ছোটো এক পিস মিষ্টিও বোধহয় একসাথে খেতে
পারবনা। আর স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ যারা বেঞ্চে বসে থাকবেন তারা আপনাকে শোনাবেন বয়সকালে
তারা কোন সাইজের কতগুলি মিষ্টি এক প্লেটে খেতে পারতেন।
ভীমকায় রসগোল্লা
|
মন্দির গাত্রের লিপি
|
আমার বাবার কাছে জেনেছি এই
গ্রামের পূর্বতন নাম ছিল রায়দোগাছিয়া, গ্রামের জমিদারদের নাম অনুসারে। তাদেরই বানানো
নাটমন্দির, দোলমঞ্চ, দুর্গা মন্ডপ, মদনমোহন মন্দির, পুকুরের ধার ধরে ষোড়শ
শিবমন্দির পুরনো বাংলার টেরাকোটা শিল্পের উজ্জ্বলতম নিদর্শন বহন করে চলেছে।
জমিদারি প্রথার অবসানে এবং ত্রিস্তরিয় পঞ্চায়েত ব্যাবস্থা চালু হবার পর এগুলি
জনসাধারনের সম্পত্তি। কালের নিয়মে অনেকটাই আজ ক্ষয়প্রাপ্ত। আমার মায়ের কাছে শুনলাম
কিভাবে মন্দিরগুলি নিচু হয়ে এসেছে। প্রতিটা মন্দির বেশ কয়েক ফুট করে মাটিতে বসে
গেছে। ফলে মন্দিরগাত্রে চিড় ধরেছে ও খানিকটা হেলে পড়েছে।
আগে এখানে চারদিন কৃষ্ণের চারটি রূপকে
পুজা করা হত। প্রতিদিন যে ঠাকুরের দোল সেই ঠাকুরকে সকালবেলায় সুসজ্জিত
দোলায় বা পালকিতে করে দোলমঞ্চে নিয়ে আসা হয়।
মদনমোহন, রাধানাথ, গোপীনাথ ও কৃষ্ণচন্দ্র। এর ভিতর আমার ঠাকুরদার আমলেই মন্দির
থেকে চুরি হয়ে যায় সুসজ্জিত অষ্টধাতুর কৃষ্ণচন্দ্রের মূর্তিটি। সেই থেকে মদনমোহনের
মূর্তি দুদিন পুজো পায়। ঘুরে ঘুরে
অনেক আগের দেখা মন্দির গুলি আবারও নিজেরাও
দেখলাম, বাড়ির নতুন দুই সদস্যকেও (আমার কন্যা এবং ভ্রাতৃবধূ) দেখানো হল।
টেরাকোটার মন্দির
|
মেলা এবং মিষ্টির টানে বহু
জায়গা থেকে লোক সমাগম হয় আজকাল। শহরের লোকেরাও গাড়ি করে বড়োবড়ো হাঁড়ি জাতীয় পাত্র
নিয়ে এসেছেন। অনেক দিন বাদে গিয়ে বুঝলাম আমার দেশের বাড়ির মিষ্টি তার নাম
মাহাত্ম্য হারায়তোনিই, বরং আরোও প্রচার পেয়েছে। গ্রামের লোকেরাও বোধহয় এর পর্যটন
গুরুত্ব বুঝেছে। নিজেদের মধ্যে প্রচুর রঙ ও আবির খেললেও অতিথিকে রাঙিয়ে দিচ্ছেনা।
কেউ নিজে থেকে হাসিমুখে এগিয়ে এলে তবেই তার কপালে রঙ ছোঁয়াচ্ছে।
পসরা সাজিয়ে
|
সারাদিন ঘুরে প্রচুর মিষ্টি কিনে বাড়ির পথ ধরলাম। বন্ধুদের
সাথে ফিরতি পথে ঠিক হল পরে এখানে বড়ো দলে হোলি কাটাতে ফিরে আসার।
যাওয়াঃ
নবদ্বীপ
যাওয়ার পথে ছাতনির মোড় থেকে রাস্তা বাঁক নিচ্ছে গ্রামের দিকে। স্থানীয় লোকের কাছ
থেকে পথনির্দেশ যাচাই করে নেওয়া ভাল।
অন্যান্য দ্রষ্টব্যঃ এর সাথে আরোও দুএকদিন
যোগ করলে কালনা, নবদ্বীপ, মায়াপুর ইত্যাদিও যাওয়া যেতে পারে। সময় থাকলে গঙ্গা
বক্ষে নৌকা ভ্রমনও মনোরম হবে।
লেখাঃ নন্দিতা রায়চৌধুরী
ছবিঃ ডঃ অনিতা রায়চৌধুরী
তথ্যসহায়তাঃ সলিল কুমার
রায়চৌধুরী ও বীণাপাণি রায়চৌধুরী
No comments:
Post a Comment